সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক স্তম্ভপ্রতিম কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ (১৯২২-৭১)। 'কল্লোল’-এর ধারাবাহিকতা তার ভিতরে প্রবাহিত, আবার তিনি নতুন বাংলা কথাসাহিত্যেরও এক বলিষ্ঠ উদ্গাতা। জগদীশ গুপ্ত ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তরসূরি এই লেখক অগ্রজদের কাছ থেকে পাঠ গ্রহণ করেছেন; করে এগিয়ে গিয়েছেন অনেক দূর অবধি। সাম্প্রতিক কথাসাহিত্যিকদের মধ্যেও যে তার উৎসারিত জনধারা প্রবহমান, এও তাঁর সৃজনী সচলতার এক সাক্ষ্য। অথচ তার সমগ্র রচনা কতটুকুই-বা : দুইটি গল্পগ্রন্থ, তিনটি উপন্যাস, তিনটি নাটক, কিছু অনুবাদ, অগ্রন্থিত কিছু কবিতা-গল্প-একাঙ্ক-প্রবন্ধ-গ্রন্থালােচনা। এই গল্প ও মহার্ঘ ঐশ্বর্যই তাকে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এক কৃতী পুরুষে পরিণত করেছে, প্রথম আধুনিক বাঙালি-মুসলমান কথাসাহিত্যিক রূপে মহিমা দিয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও মীর মশাররফ হােসেন থেকে যে-বাংলা কথাসাহিত্যের ধারা উৎসারিত হয়েছে, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তার উত্তরসূরি ঔপন্যাসিক। ঔপন্যাসিক হিশেবে, নতুন রীতির নাট্যকার ও গল্পকার হিশেবেও, তাঁর অবস্থান বাংলা সাহিত্যে অমােঘ। মাত্র আটটি গ্রন্থ রচনা করে এই কৃতিত্ব বাংলা কথাসাহিত্যে আর কে অর্জন করেছেন! | সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর গল্প-উপন্যাস-নাটকের কেন্দ্রমর্মে আছে ‘উন্মুখ প্রবৃত্তি’ আর ‘মনােভাবের
বিশ্লেষণ’ (জগদীশ গুপ্তের ভাষায়)। বিংশ শতাব্দীর | সূচনামুহূর্তে রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি' উপন্যাসে | এই বিষয়গুলি উত্থাপিত হয়। বহির্জগতের রূপায়ণ তাে আছে; থাকবেই; তার সঙ্গে যুক্ত হল ব্যক্তি ও সমাজের দোলাচল, ব্যক্তির আরণ্যক অন্তর্ভুবন। আধুনিক কথাসাহিত্য বাস্তবের এই অন্তঃশায়ী তল্-টিকে আবিষ্কার করেছে, ‘ভিতরকার মানুষ’-এর অবিরল উন্মােচন তার অভীষ্ট। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ সমগ্র সাহিত্যকর্মে জীবনের এই ভিতর-লােকই উদ্ঘাটিত। তার মানে এই নয় যে তিনি বাইরের বাস্তবকে অবহেলা করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র থেকে তিরিশের লেখকদের রচনায় সমাজের উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্তের জীবনে নেমে এসেছে বাংলা কথাসাহিত্য। মাত্র ষাট-সত্তর বছরের মধ্যেই বাংলা কথাসাহিত্যে দুর্নিবার হয়ে উঠলাে সাধারণ মানুষ। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর গল্প-উপন্যাস-নাটকেও আমরা দেখি এইসব সাধারণ মানুষদের : মাজারের খাদেম, গ্রামের স্কুল-মাস্টার, মফস্বল শহরের স্কুল-মিস্ট্রেস, নৌকার মাঝি, স্টিমারের সারেং, খালাসি, ভিখিরি, ভিখিরিনী, খুনি, কৃষক, মৌলবি, পীরসাহেব—এবং আরাে অনেকে। এইসব সাধারণ মানুষের জীবন। নিয়েই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ রচনা করেছেন অন্তর্দর্শী অসামান্য আলেখ্যমঞ্জরি। তা কোথাও বাস্তবকে অতিক্রম করেনি, বরং বাস্তবের আন্তরশাসকে ঘেঁকে। তুলেছে। আশ্চর্য সংযত সংহত নিরুত্তেজ গভীর গম্ভীর তাঁর রচনা। তার ভিত্তি বাস্তবতায়, কিন্তু দুর্গের শীর্ষে পাখির মতাে, তার উড়াল কোনাে গহীন প্রতীকতায়। | দীর্ঘকাল সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ছিলেন দেশের। বাইরে, কিন্তু তাঁর রচনার কেন্দ্র থেকে গেছে। বাংলাদেশের গ্রাম; সমাজের উচ্চ কোটির অধিবাসী ছিলেন ওয়ালীউল্লাহ্, কিন্তু তার গল্প-উপন্যাস-নাটকে বর্ণিত হয়েছে সাধারণ মানুষেরই ইতিবৃত্ত। কথাসাহিত্যে তিনি নতুন রীতির সূত্রধর : ধূর্জটিপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়-গােপাল হালদার-বুদ্ধদেব বসু-সঞ্জয় ভট্টাচার্য উপন্যাসে যে-চেতনাপ্রবাহরীতির ধারক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তা সঞ্চালিত করেছেন ছােটোগল্পে; উপন্যাসে করেছেন। অস্তিত্ববাদের প্রয়ােগ; নাটকে অজ্ঞাত সম্ভাবনার দরােজা খুলে দিয়েছেন। গৃঢ়ভাষী এই কথকের রচনায় নিয়তি ও বস্তুপৃথিবী, চাঁদ ও জলধারা, জীবন ও মৃত্যুচেতনা মিলেছে এক করতলে এসে।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সব ক'টি উপন্যাস এই সংকলনে গ্রন্থিত।